ইসলামের আলোকে মাতৃভাষার গুরুত্ব
আমরা বাঙালি জাতি। বাংলা
আমাদের মাতৃভাষা, প্রাণের ভাষা। জন্মের পর ডান কানে আজান ও বাম কানে একামতের পরেই যে
ভাষা শ্রবণ করেছি তা হলো বাংলা ভাষা। তাই শিশুকালে মায়ের মুখ থেকে শুনে শুনে একটি
দুটি করে বাংলা ভাষায় কথা বলতে শিখেছি। এ জন্য আমরা বাংলা ভাষাকে মায়ের ভাষা বলি।
পৃথিবীতে বহু ভাষা রয়েছে।
আল্লাহতায়ালা মানুষকে ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন।
তিনি তাঁর কালাম কোরআনে কারীমে
বলেন :
وَمِنْ آيَاتِهِ خَلْقُ
السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافُ أَلْسِنَتِكُمْ وَأَلْوَانِكُمْ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ
لَآيَاتٍ لِّلْعَالِمِينَ ﴿٢٢﴾
আর মহান আল্লাহর নিদর্শনগুলোর
মধ্যে (একটি নিদর্শন হলো) আসমান ও জমিন সৃষ্টি এবং মানুষের ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতা।
এর মধ্যে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য উপদেশ রয়েছে। (সুরা রূম : আয়াত : ২২)
এই আয়াতে আল্লাহতায়ালা পৃথিবীর
মানুষের ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতাকে তাঁর একটি নিদর্শন বলে আখ্যায়িত করেছেন। ভাষার
জ্ঞান ও হূদয়গ্রাহী বর্ণনায় বক্তব্য উপস্থাপন করার যোগ্যতা ও দক্ষতা ইসলামের
গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
সুন্দর ভাষায় বক্তব্য উপস্থাপন
ও উত্তম বাচনভঙ্গিতে কথা বলতে অপারগতার কারণেই হজরত মুসা (আ.) দীনের দাওয়াত নিয়ে
ফিরআউনের কাছে যাওয়ার সময় সুন্দর ভাষা ও হূদয়গ্রাহী কথাবার্তায় পারঙ্গম স্বীয় ভাই
হারুন (আ.)কে নিজের সঙ্গী করার জন্য
আল্লাহতায়ালার কাছে আবেদন
জনিয়ে তিনি বলেছিলেন :
وَأَخِي هَارُونُ هُوَ
أَفْصَحُ مِنِّي لِسَانًا فَأَرْسِلْهُ مَعِيَ رِدْءًا يُصَدِّقُنِي ۖ إِنِّي
أَخَافُ أَن يُكَذِّبُونِ ﴿٣٤﴾
‘আমার ভাই হারুন, তিনি আমার থেকে
অনেক কথাবার্তায় বেশী বাক্পটু। তাই আপনি তাকে
আমার সহযোগী করে প্রেরণ করুন; যাতে সে আমাকে (দাওয়াতের
ক্ষেত্রে তার প্রঞ্জল ভাষার দ্বারা) সত্যায়িত করে। কেননা আমি আশঙ্কা করছি (আমার
বক্তব্য সত্য হওয়া সত্ত্বেও) তারা আমাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করবে।’ (সূরা কাসাস; আয়াত : ৩৪)
মানুষের হেদায়াতের জন্য
আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে যত নবী রসুল প্রেরণ করেছেন, তাঁদের
প্রত্যেককেই তাঁদের মাতৃভাষায় বা স্বগোত্রীয় ভাষায় প্রেরণ করেছেন। যাতে তাঁরা
তাঁদের জাতিকে সুস্পষ্ট ভাষায় আল্লাহতায়ালার হুকুম বুঝাতে পারেন এবং মানুষও নবী
রসুলের ভাষা বুঝে আমল করতে পারে।
এ জন্য আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক
নবীর কিতাব তাঁর ভাষায়ই অবতীর্ণ করেছেন।
যেমন : হজরত মুসা (আ.)-এর ওপর
তাওরাত অবতীর্ণ করেছেন হিব্রু ভাষায়,
হজরত দাউদ (আ.)-এর ওপর জবুর
অবতীর্ণ করেছেন ইউনানি ভাষায়,
আর হজরত ঈসা (আ.)-এর ওপর
ইঞ্জিল অবতীর্ণ করেছেন সুরিয়ানি ভাষায়।
সমগ্র জাতির হেদায়াতের
পথপ্রদর্শক শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর প্রদর্শিত পথেই রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতের
কল্যাণ। তাঁর ওপরই অবতীর্ণ হয়েছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। আর এ
কোরআন মহা নবী (সাঃ) এর মাতৃভাষায় আরবীতে অবতির্ণ।
আল্লাহতায়ালা তাঁর কালাম কোরআন
মাদিদে এ কথা বলেছেন-
وَمَا أَرْسَلْنَا مِن
رَّسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ
‘আমি প্রত্যেক
নবীকেই তাঁর নিজ নিজ জাতির ভাষায় প্রেরণ করেছি; যেন তিনি তাদের
সুস্পষ্টভাবে বুঝাতে পারেন।’ ( সুরা ইব্রাহিম
আয়াত : ০৪)
মাতৃভাষা বাংলাকে বাংলা মায়ের
কোলেই আজীবন রাখার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের দেশের কিছু সাহসী যুবক
বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো জাতি ভাষার জন্য
প্রাণ দেয়নি। একমাত্র বাঙালি জাতিই ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে পৃথিবীতে মাতৃভাষার
সম্মান আকাশচুম্বী করেছে। তাই পৃথিবীবাসী ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা
দিবস হিসেবে গ্রহণ করেছে।
কোরআন-হাদিসের মাধ্যমে
মাতৃভাষার গুরুত্ব যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে; সেভাবে জব্বার, রফিক, সালাম, বরকতের মতো সাহসী
মানুষের আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলা ভাষার এক আলোকোজ্জ্বল সূর্য পৃথিবীর আকাশে উদিত
হয়েছে।
বর্তমান সময়ে বাংলার চর্চা ও
ব্যবহারের করুণ অবস্থার দিকে লক্ষ্য করলে হতাশ হওয়া ছাড়া আর কী করার আছে? বর্তমানে মানুষের
মাঝে বাংলা-ইংরেজির সংমিশ্রণ যে হারে বেড়ে চলছে এবং বিজাতীয় সংস্কৃতি আমদানির যে
প্রতিযোগিতা দেশে চলছে বাঙালিপনা আর বাংলা ভাষার অস্তিত্ব টিকে থাকাই দায়।
আগের যুগে আরবের শহরের ছোট
বাচ্চাদের স্বচ্ছ ও শুদ্ধ আরবি ভাষা শেখার জন্য গ্রামে পাঠানো হতো। গ্রামের
লোকেরাও শহরে শিশুদের নিয়ে যাওয়ার জন্য শহরে চলে আসত। যা আমরা রসুল (সা.)-এর জীবনী
থেকে জেনে আসছি। তাদের মতো হয়তো আমাদের দেশের শহরে শিশুদেরও মাতৃভাষায় কথা বলতে ও
বাঙালি সংস্কৃতি অর্জন বা খাঁটি বাঙালি হতে গ্রামে পাঠাতে হবে।
পরিশেষে শিক্ষিত সমাজের কাছে এ
আবেদন করি তারা যেন মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেন।
আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে তৌফিক দান করুন। আমিন।
No comments